প্রাচীন যুগ

তথ্যের ঘাটতির কারণে বাংলার মুসলিম শাসন পূর্ববর্তী ইতিহাস উদ্ধার করা বেশ দুরূহ, আর গুপ্তযুগের (৪র্থ শতাব্দী) আগের ইতিহাস জানা প্রায় অসম্ভব। চতুর্থ শতকের আগের কথা জানার জন্য নির্ভর করতে হয় বেদ, পুরাণ, ও মহাকাব্যিক সাহিত্য, এবং সামান্য কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপর। কিন্তু চতুর্থ শতকে গুপ্ত রাজবংশের শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে লিখিত দলিল পাওয়া যেতে শুরু করে, যার মধ্যে আছে শিলালিপি এবং সাহিত্যিক রচনা।

বর্তমানে আমরা যে অঞ্চলকে বাংলা নামে চিনি বৈদিক সাহিত্যের কথা অনুসারে সেখানে প্রাচীনকালে নানা অনার্য জনগোষ্ঠীর বাস ছিল, এবং অধিকাংশ অঞ্চলকে সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নামেই ডাকা হতো, যেমন: গৌড়, পুণ্ড্র, বঙ্গ, এবং রাঢ়। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও ছিল; বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে, মেঘনার পূর্ব পাশে অবস্থিত জনপদটির নাম ছিল সমতট, যা কোনো নৃগোষ্ঠীর নাম নয় বরং পুরোপুরিই বর্ণনামূলক। তেমনি চট্টগ্রাম ও তার আশপাশের অঞ্চল নিয়ে গঠিত জনপদটির নাম ছিল হরিকেল। এই ছয়টি জনপদের নামই শেষ দিককার বৈদিক সাহিত্যে উল্লেখিত আছে।

ভারতে আর্যরা আসন গেড়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের মধ্যভাগে, অর্থাৎ আজ থেকে আনুমানিক ৩৫০০ বছর পূর্বে। কিন্তু শুরুর দিকে সেই প্রভাব কেবল ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ কারণে বাংলায় প্রাকার্য সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার অনেক সুযোগ পেয়েছে। আর্যরা প্রথম বাংলা অধিকার করা শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের দিকে, কিন্তু পুরো বাংলার আর্যায়ন ঘটতে আরো ১ হাজার বছর লেগে যায়, এবং সেই সময়ের মধ্যেও আর্যদের প্রভাব কখনো অতিপ্রকট ছিল না। তাই প্রাকার্য এবং অনার্য অনেক কিছুই বাংলা থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারেনি।

বাংলার প্রাচীনতম অধিবাসীরা কত বছর পূর্বে এদেশে এসেছিল তা জানার সর্বোত্তম উপায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বাঁকুরা, ও বর্ধমানে প্রাগৈতিকাসিক প্রস্তর হাতিয়ার পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলোর ব্যবহারকারীরা ঠিক কত আগে এখানে বাস করতে শুরু করেছিল তা নির্ণয় তো দূরের কথা, অনুমান করাও সম্ভব নয়। সেটা আজ থেকে ১০ হাজার বছর বা আরো বেশি পূর্বে হতে পারে। সেই আদিমতম বসতি স্থাপনকারীরা ছিল বিভিন্ন অস্ট্রিক বা আস্ট্রো-এশীয় (যেমন নিষাদ) অনার্য গোত্রের, যাদের আধুনিক প্রতিনিধি বলা যেতে পারে সাঁওতাল, কোল, ভিল, পুলিন্দ, শবর ইত্যাদি জনগোষ্ঠীগুলোকে। পরবর্তীতে আরো দুইটি গোষ্ঠীর মানুষ বাংলায় এসেছিল যাদের ভাষা ছিল যথাক্রমে দ্রাবিড় এবং তিব্বতি-বর্মি। বর্ধমান জেলার বোলপুরের নিকটবর্তী অজয় নদীর উপত্যকায় আবিষ্কৃত পাণ্ডু রাজার ঢিবি, এবং কোপাই, অজয় ও কুনার নদীর কাছাকাছি প্রাপ্ত আরো বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান বাংলার ইতিহাসের প্রাচীন অধ্যায় সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য দিয়েছে। পাণ্ডু রাজার ঢিবি একটি প্রাচীন বাণিজ্য নগরীর ধ্বংসাবশেষ, যে নগরীর সাথে শুধু ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানই নয়, সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোরও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৩য় থেকে খ্রিস্টীয় ১ম শতকের কিছু গ্রিক ও লাতিন লেখায় পূর্ব ভারতের সমরবিদ্যায় পারদর্শী একটি জাতিরাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাকে তারা গঙ্গারিদি (গ্রিক) বা গঙ্গারিদাই (লাতিন) নামে ডাকত। বিশেষজ্ঞদের মতে এই রাজ্যের অবস্থান ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়, গঙ্গার মোহনার (ভাগিরথী ও পদ্মা) চারপাশে। বগুড়া জেলার মহাস্থানের ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপি থেকে ৩য় খ্রিস্টপূর্বাব্দে বাংলার কিছু অংশে শিথিল মৌর্য শাসনের প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রায় ১২শ শতক পর্যন্ত স্থানে স্থানে মৌর্য আমলের মতো নগরকেন্দ্রিক প্রশাসন টিকে ছিল। তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে আছে, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় তৈরি মিহি সূতিবস্ত্রের সমগ্র ভারতে কদর ছিল। সমসাময়িক গ্রিক ও লাতিন লেখকরাও এই বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এসব থেকে বুঝা যায়, বাংলায় মিহি সূতিবস্ত্র বয়নের ঐতিহ্য বহু পুরনো। এছাড়া পোড়ামাটির ফলক তৈরিও বাংলার আরেকটি প্রাচীন ঐতিহ্য, পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে যার প্রত্যক্ষ নমুনা পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ৪র্থ শতকে গুপ্ত শাসন সূচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলার অবস্থা সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে মহাস্থানগড়, তাম্রলিপ্তি ও চন্দ্রকেতুগড়ে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব ১ম ও ২য় শতকের পোড়ামাটির মূর্তি প্রমাণ করে যে, শুঙ্গ ও কুষাণ আমলেও বাংলার বিকাশ অব্যাহত ছিল। পেরিপ্লুস মারিস এরিথ্রেস (এরিথ্রীয় সাগরের পেরিপ্লাস) এবং টলেমির বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায় যে, খ্রিস্টীয় ১ম ও ২য় শতকে সমগ্র বাংলা ব-দ্বীপ একটি শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে সুসংগঠিত ছিল, যার রাজধানী ছিল গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত গঙ্গা নামক একটি বৃহৎ বাণিজ্য নগরী। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের বৌদ্ধ গ্রন্থ মিলিন্দ'র প্রশ্ন-তে সমুদ্র বন্দর বিশিষ্ট বণিক জনপদগুলোর তালিকাটিতে বঙ্গের নাম আছে।


Comments

Popular posts from this blog

মুঘল সাম্রাজ্য [ জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর ]

গুপ্ত, গৌড়, সেন, পাল ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজবংশসমূহ

পূর্ব ভেইল নীহারিকা