গুপ্ত, গৌড়, সেন, পাল ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজবংশসমূহ

গুপ্ত শাসনামল

বাংলার খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক পরবর্তী ইতিহাস ধীর আর্যায়নের ইতিহাস, অনার্যদের শিল্প-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য লুপ্ত হয়ে ধীরে ধীরে আর্য প্রভাব বিস্তারের ইতিহাস। অনুমান করা যায় যে, ৪র্থ শতকে সমুদ্রগুপ্তের নেতৃত্বে গুপ্ত সম্রাজ্যের বিস্তৃতির সময় বাংলা ছোটো ছোটো অনেকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এই শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে অধিকাংশ স্বাধীন রাষ্ট্রই সমুদ্রগুপ্তের করতলগত হয়। কুমিল্লা-নোয়াখালি অঞ্চল নিয়ে গঠিত সমতট তার সারাসরি কর্তৃত্বাধীনে না আসলেও, একটি সাধারণ করদরাজ্যে পরিণত হয়। সমুদ্রগুপ্তের ছেলে ও উত্তরসূরী চন্দ্রগুপ্ত ২ পূর্ব দিকে গুপ্ত সম্রাজ্য আরো বর্ধিত করেন, এবং বঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তার প্রভাব আরো সুসংহত করেন। সমতটের উপর গুপ্ত সামন্তেশ্বরদের অধিরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে আরো সময় লেগেছে; ৬ষ্ঠ শতকে প্রথম এই অঞ্চলের শাসনকর্তার নামের শেষে গুপ্ত (বৈণ্যগুপ্ত) দেখা যায়। উত্তরবঙ্গে পাওয়া ৫ম শতকের বেশ কয়েকজন গুপ্ত সম্রাটের (কুমারগুপ্ত, বুধগুপ্ত) তাম্রশাসন প্রমাণ করে যে, সে সময়ের মধ্যে প্রায় পুরো বাংলায় গুপ্ত শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এ থেকে একইসাথে একটি সুসংগঠিত স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রমাণ পাওয়া যায়, যে ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় লোকজন তাদের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। এটি নিঃসন্দেহে বাংলায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রথম নিদর্শন।
গুপ্তযুগে বাংলা নিখিল ভারত গুপ্ত সম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে খাইবার গিরিপথ দিয়ে আসা ইরানীভাষী ইন্দো-হেপথালাইট গোত্র হুনা-দের আক্রমণে গুপ্ত সম্রাজ্যের পতন, এবং উত্তর-মধ্য ভারতের সিংহাসনে যশোধর্মের হঠাৎ আগমন ও প্রস্থান বাংলার জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। ৬ষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলা গুপ্ত প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্থানীয় নেতাদের অধীনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে, যার নাম বঙ্গরাজ্য। উত্তর-মধ্য ভারতে যখন মৌখরি রাজবংশ ক্ষমতায় আসে তখন শেষ দিককার গুপ্তদের অধিকারে ছিল কেবল বিহার, এবং উত্তর ও পশ্চিম বাংলা। মৌখরি ও শেষ দিককার গুপ্ত রাজাদের মধ্যে মগধ, এবং উত্তর ও পশ্চিম বাংলার কিছু অংশের অধিকার নিয়ে দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব চলেছিল।

গৌড় রাজ্য

ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধে শেষ দিককার গুপ্ত রাজাদের নেতৃত্বে উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সপ্তম শতকের শুরুর দিকে শশাঙ্ক এই রাজ্য দখল করে নেন, এবং মগধও তার কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে। শশাঙ্ক নিঃসন্দেহে বাংলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতাপশালী রাজা, কারণ তিনিই প্রথম নিজ ভূমি সুসংহত করে সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে উত্তর ভারতের আরো অঞ্চলকে বাংলাকেন্দ্রিক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। সে হিসেবে তিনিই পরবর্তী পাল রাজা ধর্মপাল ও দেবপালের উত্তর ভারতের প্রতি আগ্রাসী নীতির পথপ্রদর্শক। শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় এক শতাব্দীকাল (৬৫০-৭৫০) বাংলায় অরাজকতা বিরাজ করে, এবং এ সময়কার গৌড় রাজাদের সম্পর্কেও বেশি কিছু জানা যায়না। এ সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, হর্ষবর্ধণের মৃত্যু (৬৪৭/৪৮), মৃত্যুর পর তার মন্ত্রীদের তার রাজ্যের বিভিন্ন অংশ জবরদখল, চৈনিক দূত সুয়ানজাং (হিউয়েন সাঙ) এর অভিযাত্রা, এবং তৎপরবর্তীতে তিব্বতী সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা স্রোঙ্তসান গাম্পো-র আক্রমণ। সপ্তম শতকের শেষার্ধে বাংলায় দু'টি নতুন রাজবংশের উত্থান ঘটে: গৌড় ও মগধে (উত্তর ও পশ্চিম বাংলা) শেষ দিককার গুপ্ত রাজবংশ, এবং বঙ্গ ও সমতটে (দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) খড়গ রাজবংশ। অবশ্য এই দুই বংশের কেউই খুব বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি।
অষ্টম শতকের প্রথমার্ধে বাংলা মুহুর্মুহু বিদেশী আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে উঠে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কনৌজের রাজা যশোবর্মণের (৭২৫-৭৫২) আক্রমণ। অবশ্য তার গৌরব অচিরেই কাশ্মিরের ললিতাদিত্যের হাতে ম্লান হয়ে যায়। কাশ্মিরী ইতিহাসবিদ কলহনের মতে, ললিতাদিত্য ৫ জন গৌড় রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, গৌড় রাজারা খুব বিভক্ত ছিল, তাদের মধ্যে অন্তর্কলহ চলত, এবং কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকায় যে কেউ একটি নতুন জায়গাকে স্বাধীন ঘোষণা করতে পারত। পরবর্তী অন্যান্য বিদেশী আক্রমণ ধীরে ধীরে গৌড় রাজ্যকে আরো ছিন্নভিন্ন করতে থাকে। অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়ে, গোপালের উত্থানের পূর্বে বাংলার সমাজ-রাজনৈতিক অবস্থাকে পাল যুগের একটি লিপিতে (খালিমপুর তাম্রশাসন) মাৎস্যন্যায়ম (চরম অরাজক) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

পাল সম্রাজ্য

অষ্টম শতকের মধ্যভাগে গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাল রাজবংশ প্রায় ৪০০ বছর ব্যাপী বাংলা, এবং সময় সময় উত্তর ভারতের একটি বড় অংশ শাসন করেছে। এই দীর্ঘ শাসনামলে পাল রাজাদের ১৮টি প্রজন্ম সিংহাসনে আরোহণ করেছে, যুগে যুগে রাজত্বের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেছে এবং রাজাদের ক্ষমতারও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। তথাপি সার্বিকভাবে পাল যুগকে প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে গৌরবময় যুগ বলা যায়। পাল সম্রাজ্যের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করা যায়:
  1. ধর্মপাল (৭৮১-৮২১) ও দেবপালের (৮২১-৮৬১) অধীনে উত্থানের যুগ,
  2. মহিপাল ১ (৯৯৫-১০৪৩, যাকে এই সম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বা দ্বিতীয় জনক বলা হয়) এর সিংহাসন গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত বিরাজমান স্রোতোহীনতার যুগ, এবং
  3. সবশেষে পতন ও বিচ্ছিন্নতার যুগ, রামপালের (১০৮২-১১২৪) বলিষ্ঠ নেতৃত্ব যা কিছুটা দমাতে পারলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
রামপালের তিরোধানের পর পাল রাজবংশ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, এদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে দ্বাদশ শতকের তৃতীয় চতুর্থাংশে সেন রাজবংশের উত্থানের মাধ্যমে।
উত্থানের যুগে ধর্মপাল ও দেবপালের অধীনে পাল রাজবংশ বাংলা ছাড়িয়ে ভারতের উত্তরাংশের অনেক স্থান নিজেদের করতলগত করেছিল। অধিকাংশ ভারতের অধীশ্বর হওয়ার জন্য তারা পশ্চিম ভারতের গুর্জর-প্রতিহার এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটদের সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।
ধর্মপাল বৌদ্ধ ধর্মের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বর্তমান বিহারের ভাগলপুর থেকে ২৪ মাইল পূর্বে পাথরঘাটা নামক স্থানে যে বিক্রমশীলা মহাবিহারের ধ্বংসস্তূপ দেখা যায় সেটি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নবম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এটি ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষাঙ্গনের একটি ছিল। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও তার। ধর্মপালের পুত্র ও উত্তরসূরী দেবপাল পিতার আগ্রাসী নীতি অনুসারে উত্তর ভারতের কর্তৃত্বের লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। ধর্মপাল ও দেবপালের সময়টা পাল সম্রাজ্যের উত্থানের যুগ। এ সময় সমগ্র উত্তর ও পশ্চিম বাংলা এবং বিহার পাল সম্রাজ্যের অধীনে এসেছিল। উত্তর ভারতের সবাইকে তখন এই রাজ্যকে সমীহ করে চলতে হতো, এবং বিদেশী শক্তির আক্রমণে ঠেকানোর মতো ক্ষমতা তাদের ছিল। দেবপালের মৃত্যুর পর অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে; একটি দীর্ঘ সময় ধরে সম্রাজ্যের অবনতি ঘটতে থাকে যাকে আমরা স্রোতোহীনতার যুগ বলে আখ্যায়িত করেছি। মহিপাল ১ এসে আবার এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটান। স্রোতোহীনতার যুগ ১০০ বছরেরও বেশি সময় স্থায়ী ছিল, যে সময়ের মধ্যে পাল রাজাদের পাঁচটি প্রজন্ম গত হয়। সে সময় অন্যদের আক্রমণ করা তো দূরের কথা, বাইরের আক্রমণ ঠেকানো বা নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসনের শক্তিও রাজন্যবর্গের ছিল না। এই সুযোগে ১০ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ও পশ্চিম বাংলার কিছু অংশে কম্বোজ-রা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তখন পাল সম্রাজ্য তাই কেবল বিহারেই সীমাবদ্ধ ছিল। শিলালিপি থেকে কম্বোজ গৌড়পতিদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। মহিপাল ১ (৯৯৫-১০৪৩) পাল সম্রাজ্যকে আবার স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনেন। তিনি উত্তর ও পশ্চিম বাংলাকে আবার সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে সম্রাজ্যের ভিত পাকাপোক্ত করেন। কিন্তু তার উত্তরসূরীরা সেই ঐতিহ্য বজায় রাখতে পারেনি, তাদের সময় সম্ভবত পাল সম্রাজ্যের ঐশ্বর্য তলানীতে গিয়ে ঠেকেছিল। উত্তর ভারতের কলচুরি, চন্ডেলা ইত্যাদি শক্তির পুনঃপুনঃ আক্রমণ এই দুর্বলতারই সাক্ষ্য দেয়। তবে মহিপাল ২ (১০৭৫-৮০) এর রাজত্বকালে পাল সম্রাজ্যের করুণ দশা যতোটা মূর্ত হয়ে উঠেছিল ততোটা আগে কখনো হয়নি। এ সময় বরেন্দ্র (উত্তর বঙ্গ) অঞ্চলে কৈবর্তদের প্রধান নেতা দিব্য সামন্ত বিদ্রোহের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। রামপালের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্যন্ত এই খণ্ডায়ন আর দুর্বলায়ন চলতেই থাকে।
রামপালের (১০৮২-১১২৪) শাসনামলকে পাল সম্রাজ্যের শেষ অগ্নিচ্ছটা হিসেবে অভিহিত করা যায়। তিনি উত্তর বাংলাকে আবার বশে এনেছিলেন এবং আরো সম্প্রসারণেচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার উত্তরসূরীরা সেই ধারা অব্যাহত রাখতে একেবারেই ব্যর্থ হয়। বিজয়সেন এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তার হাত ধরেই পাল সম্রাজ্যের পতন ঘটে বাংলায় সেন রাজবংশের শাসনের শুরু হয়।

একটি সম্রাজ্য প্রায় চার শতাব্দীকাল ধরে শাসন করায় বাংলা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আশীর্বাদে ধন্য হয়েছিল। পালরা একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরিতে সমর্থ হয়েছিল। তাদের ভূকেন্দ্রিক সম্রাজ্যের প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ। পাল অর্থনীতিতে বাণিজ্যের ভূমিকা ছিল খুবই সামান্য। বাণিজ্য হতো মূলত সম্রাজ্যের ভেতরে, এবং সর্বোচ্চ আশপাশের কিছু অঞ্চলের সাথে। ৮ম শতকে তাম্রলিপ্তির পতন ঘটায় পালরা বাংলার সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্যে ভাগ বসাতে পারেনি। পাল সম্রাজ্যের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় সহনশীলতা। বাংলার অধিকাংশ মানুষ হিন্দু হলেও পাল রাজারা ছিল বৌদ্ধ। তাই সে সময় বাংলার হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে এক ধরণের সম্প্রীতি গড়ে উঠেছিল যা হয়ত পরবর্তীতে বাংলায় ভিন্ন ধর্মের (ইসলাম) অবাধ প্রবেশ সম্ভবপর করে তুলেছে। এছাড়া পাল যুগে চারু ও কারুকলায়ও অনেক উন্নতি ঘটেছিল। সোমপুর মহাবিহারের স্থাপত্যরীতি এতটাই উৎকৃষ্ট ছিল যে তা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের স্থাপত্যকেও প্রভাবিত করেছিল। পালদের ভাস্কর্য শিল্প পূর্ব-ভারতের কারুশিল্পের ইতিহাসের একটি পৃথক অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। বলা যায়, এই যুগেই বাংলার ভাস্কররা সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পেরেছিল। পাল যুগের সাহিত্য সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না, কারণ তার খুব কম নিদর্শনই আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তবে যতটুকু পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় উত্তর বাংলার কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর দ্ব্যর্থবোধক শ্লোকের সংকলন রামচরিতম, যা শ্লোকসাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলোর একটি। পরবর্তী যুগের কাব্য সংকলনে ১০ম ও একাদশ শতকের অনেক কবির রচনা স্থান পেয়েছে। এই সবকিছুর বিচারে পাল শাসনামলকেই বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজবংশসমূহ

পাল রাজারা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাকে কখনও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। আসলে একটি দীর্ঘ সময় ধরেই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা, অর্থাৎ বঙ্গীয় ব-দ্বীপ (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মোহনা) অঞ্চলে স্বশাসন বিরাজমান ছিল। গুপ্ত রাজত্বের পতনের পর থেকে সেন রাজবংশের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চল উত্তর ও পশ্চিম বাংলা থেকে রাজনৈতিকভাবে পৃথক ছিল। সময় সময় অবশ্য রাজনৈতিক একত্রীকরণের প্রচেষ্টা চলেছে। বাংলার সমুদ্র বাণিজ্যের কর্তৃত্ব ছিল দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজাদের হাতে। এ কারণেই উত্তর ও পশ্চিম বাংলার পাল রাজারা কখনো এই বাণিজ্যের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি।

চট্টগ্রাম-কুমিল্লা অঞ্চলের সুদীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের কারণে এখানকার সামুদ্রিক বাণিজ্য বেশ লাভজনক ছিল। এই সম্রাজ্যের নানা স্থানে প্রচুর রৌপ্যমুদ্রার উপস্থিতি তা প্রমাণ করে। নবম ও একাদশ শতকের মধ্যে লিখিত কিছু দলিলে আরব বণিক ও নাবিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা এই অঞ্চলের বন্দরটিকে "সমন্দর" (বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দর) নামে ডাকত। রৌপ্যমুদ্রা তৈরির জন্য যে রূপার পাত দরকার ছিল তা রাজারা এই বাণিজ্য থেকেই পেত। সে সময় এখানে নৌযান বানানো হতো বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব কারণে তদাননীন্তর দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় প্রথম স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৬ষ্ঠ শতকে, রাজ্যটির নাম ছিল বঙ্গ। ছয়টি তাম্রশাসন থেকে সে সময়কার বঙ্গরাজ্যের তিন জন রাজার নাম জানা গেছে: গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য, ও সমাচারদেব। শশাঙ্ক দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন কি-না তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। অনেক গবেষক আবার এ অঞ্চলে "ভদ্র" উপাধিধারী একটি পৃথক রাজবংশের অস্তিত্ব ছিল বলে ধারণা করেন।

খড়গ রাজবংশ

সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন শেষ দিককার গুপ্ত রাজারা পশ্চিম বঙ্গে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তখন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে খড়গ রাজবংশের উত্থান ঘটে। সমতট (কুমিল্লা-নোয়াখালি) অঞ্চলে এই বংশের তিনটি প্রজন্মের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের রাজধানী ছিল কর্মান্ত-বাসক (বর্তমানে কুমিল্লার কামতা)। তাম্রশাসন থেকে এছাড়া আরো দুই জন অর্ধ-স্বাধীন সামন্তপ্রভুর নাম জানা যায়: লোকনাথ ও শ্রীধারণ রাত। এরা সপ্তম শতকে সমতটের কিছু অংশ শাসন করত।

দেব রাজবংশ

দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা একটি উল্লেখযোগ্য আকারের রাজত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয় অষ্টম শতকে দেব রাজবংশের অধীনে। তাদের রাজধানী ছিল দেবপর্বত— ময়নামতী-লালমাই অঞ্চলের একটি শহর যার সঠিক অবস্থান এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তারাও মূলত সমতট শাসন করত, এবং তাদের চার প্রজন্মের চার জন রাজার নাম জানা গেছে: শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব, ও ভবদেব। এরা প্রথম দিককার পাল রাজাদের সমসাময়িক ছিল। পালদের থেকে স্বাধীন হলেও দেব রাজারা নিজেরাও ছিল বৌদ্ধ। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ময়নামতী অঞ্চল বৌদ্ধ শিক্ষাদীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। সে সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শালবন বিহার, আনন্দবিহার, ও ভোজ বিহার। পাহাড়পুরে যে ক্রুশাকৃতির কেন্দ্রীয় মন্দির দেখা যায় তার ধারণা ময়নামতী অঞ্চল থেকেই এসেছে। এই রীতির অপেক্ষাকৃত প্রাচীন ও ছোটো সংস্করণ ময়নামতীর বিহারগুলোতে দেখা যায়। ময়নামতীর ভাস্কর্য ও মৃৎশিল্পও উল্লেখযোগ্য।

চন্দ্র রাজবংশ

নবম শতকে বাংলায় হরিকেল নামে একটি নতুন রাজত্বের পত্তন ঘটে। সম্ভবত চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত অঞ্চল এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হরিকেলদের পর মঞ্চে আসে চন্দ্র রাজারা। দশম শতকের প্রথম থেকে শুরু করে পাঁচটি প্রজন্মের চন্দ্র রাজারা (ত্রৈলোক্যচন্দ্র, শ্রীচন্দ্র, কল্যানচন্দ্র, লড়হচন্দ্র, ও গোবিন্দচন্দ্র) প্রায় ১৫০ বছর (৯০০-১০৫০) ধরে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলা শাসন করেছে। বর্তমান বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং পূর্বে একেবারে সিলেট পর্যন্ত অঞ্চলটুকু নিয়ে গঠিত এই রাজ্যের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। চন্দ্ররা শৌর্যবীর্যে সমকালীন পাল রাজাদের প্রায় সমকক্ষ ছিল, এবং তাদের সময়ই পূর্ব বাংলার রাজত্ব আরো সম্প্রসারিত হয়ে একেবারে কামরূপ (আসাম) পর্যন্ত বর্ধিত হয়। তাম্রশাসনে গৌড় রাজাদের সাথে তাদের যে যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায় তা সম্ভবত হয়েছিল কম্বোজ রাজাদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে চন্দ্রদের বিজয় সম্ভবত মহিপাল ১ কে পাল রাজবংশের পিতৃরাজ্য (রাজ্যম পিত্র্যম) পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছিল।

বর্মণ রাজবংশ

একাদশ শতকের শেষ চতুর্থাংশে বর্মণ রাজারা পালদের বিরুদ্ধে কৈবর্ত্যদের বিদ্রোহের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় নিজেদের স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠিত করে। এক শতাব্দীরও কম সময় (১০৮০-১১৫০) ধরে ৫ জন বর্মণ রাজা এই অঞ্চল শাসন করেছিল, যাদের মধ্যে ছিল জাতবর্মণ, হরিবর্মণ, শ্যামলবর্মণ, ও ভোজবর্মণ। চন্দ্রদের মতো বর্মণরাও হিন্দু ছিল, এবং পরবর্তীতে সমগ্র বঙ্গের অধীশ্বর সেন রাজাদের দ্বারা তারা বিতাড়িত হয়েছিল।

সেন শাসনামল

বিজয়সেন সম্ভবত রামপালের সময় পাল সম্রাজ্যের অধীনস্থ পশ্চিম বাংলার একজন সামন্তপ্রভু ছিলেন। তার পূর্বপুরুষরা ছিল ব্রহ্মক্ষত্রিয়, এবং দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট অঞ্চল থেকে বাংলায় এসেছিল। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলায় পাল রাজাদের কর্তৃত্বের চির অবসান ঘটিয়ে সেন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। রামপালের মৃত্যুর পর পাল রাজাদের দুর্দশার সুযোগ নিয়ে তিনি নিজের প্রাধান্য বৃদ্ধি করতে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে সমগ্র পশ্চিম বাংলার ক্ষমতা দখল করেন, এবং পরবর্তীতে বর্মণদের পরাজিত করার মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। এছাড়া বিহারের উত্তরাঞ্চলও তিনি পালদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। সে সময় পাল রাজবংশের অবশিষ্টাংশ দক্ষিণ বিহারে কোনোক্রমে টিকে ছিল। ত্রয়োদশ শতকে মুসলিমদের আগনের পূর্ব পর্যন্ত সেনরাই ছিল সমগ্র বাংলা ও বিহারের কিছু অংশের অধিপতি।
সেনরা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে (১০৯৭-১২২৩) বাংলা শাসন করেছে; তাদের যে পাঁচজন রাজার নাম জানা গেছে তারা হলেন, বিজয়সেন, বল্লালসেন, লক্ষণসেন, বিশ্বরূপসেন, এবং কেশবসেন। বিজয়সেন বর্মণ ও পালদের পরাজিত করে পুরো বাংলায় সেনদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যা ১২০৪ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাই বলা যায় সেনরাই প্রথম রাজবংশ যারা পুরো বাংলাকে একটি একক নেতৃত্বের অধীনে আনতে সমর্থ হয়েছিল। একত্রীকরণের আগে সমুদ্র-বাণিজ্যের কারণে পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত বেশি সমৃদ্ধ ছিল, একত্রীকরণের পরও যে পরিস্থিতি পাল্টায়নি। এ কারণেই দেখা যায় সেনদের রাজধানীও ছিল পূর্ব বাংলার বিক্রমপুর। উল্লেখ্য, ১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজীর আক্রমণ পুরো বাংলায় সেন রাজত্বের অবসান ঘটাতে পারেনি। তিনি কেবল উত্তর ও পশ্চিম বাংলা দখল করেছিলেন; এবং লক্ষণ সেন পিছু হটে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চলে এসেছিলেন। এখানে তিনি এবং তার মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে আরো কিছুকাল শাসন করেছিলেন।


প্রথম তিন জন সেন রাজা—বিজয়সেন (১০৯৭-১১৬০), বল্লালসেন (১১৬০-৭৮), ও লক্ষণসেন (১১৭৮-১২০৬) — খুব প্রতাপশালী ছিলেন। কিন্তু যেমনটি আগেই বলা হয়েছে— খলজী'র আক্রমণের কারণে শেষ দুই জন কেবল দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার একটি ছোটো অংশ শাসন করতে পেরেছিলেন। হিন্দু সেন রাজাদের অধীনে বাংলায় হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটে। কথিত আছে যে, বল্লালসেন বর্ণপ্রথার পূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি গোঁড়া হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যা বাংলায় দীর্ঘকাল ধরে বিরাজমান হিন্দু-বৌদ্ধ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির ঐতিহ্যের পরিপন্থী ছিল। এ কারণেই সম্ভবত সে সময় বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বিলুপ্ত হতে শুরু করে। মুসলিমরা আসার পূর্বেই বাংলায় বৌদ্ধদের প্রভাব অনেক কমে যায়। হিন্দু-বৌদ্ধ বৈরীতা এবং গোঁড়া হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার পত্তন বাংলার ভবিষ্যৎ ইতিহাসকে অনেক প্রভাবিত করেছে। বাংলায় ইসলামের আগমন ও প্রসারের পেছনেও এর ভূমিকা থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। সেন যুগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে বাংলায় সংস্কৃত সাহিত্যের প্রসার। সেন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশের প্রভাবে এই যুগে সংস্কৃত চর্চার বিকাশ ঘটে। কাব্যসাহিত্যে বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর একটি হচ্ছে লক্ষণসেনের দরবারের রাজকবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দ। তার রাজসভায় অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ধোয়ী (পবনদূত রচয়িতা), উমাপতিধর, গোবর্ধন (আর্যা-সপ্তশতী রচয়িতা), এবং শরণ। এই পাঁচজনকে লক্ষণসেনের দরবারের পঞ্চরত্ন বলা হতো।

Comments

Popular posts from this blog

মুঘল সাম্রাজ্য [ জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর ]

পূর্ব ভেইল নীহারিকা